ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত – আশকার ইবনে শাইখ – ফ্রি পিডিএফ ডাউনলোড – Free PDF Download এই বইটি ডাউনলোড করে নিন এখনি। আরো নতুন নতুন বই পেতে ভিজিট করুন আমাদের বই লাইব্রেরি।
মহান আল্লাহ বলেন –
পড়ো! তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন
আল কুরআন
জগতের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রত্যেক জমানায়, প্রত্যেক সময়ে কিছু মানুষ এমন ছিল যারা অজানাকে জানতে চেয়েছে, বুঝতে চেয়েছে। অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছে বিশ্বজগতের গূঢ় রহস্য, অবলোকন করেছে পরম বিস্ময়ের সাথে মহাকাশের লীলাখেলা। এই মানুষগুলোর নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলেই আজ আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি এবং এত সুন্দর কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছি, পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের সোপান বেয়ে তরতর করে। এই পথচলার মাঝেই আরেকটি ক্ষুদ্র প্রয়াস আমাদের এই ওয়েবসাইট। এখানে বাংলাভাষায় এবং অন্যান্য সকল ভাষায় পরবর্তীতে সর্বাধিক বইয়ের লাইব্রেরি করার ইচ্ছা আমাদের রয়েছে। বারবার এই সাইট বন্ধ হয়েছে, অন্য নামে আবার এসেছে, আসবে। এইজন্যে আপনাদের সাপোর্ট প্রয়োজন। আপনারা প্রতিনিয়ত সাইটে ভিজিট করে যাবেন এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। আমাদের জানাবেন কোনো সমস্যা থাকলে।
বইটি সম্পর্কেঃ
অনুবাদঃ আশকার ইবনে শাইখ
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৭৪
ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত – বইটির এক ঝলকঃ
যে সময়কার কথা দিয়ে এ আলোচনার আরম্ভ, সে সময়ে ভারতবর্ষীয় সভ্যতার স্বর্ণদিনে অন্তসূর্যের লালিমা দেখা দিয়েছে। সিন্ধু উপত্যকা চিহ্নিত এক প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সে সভ্যতা প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব ও গৌরব বহিরাগত নর্ডিক আর্যদের। তারা ইরান হয়ে ভারতবর্ষে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। কালপ্রবাহে অতঃপর সমগ্র ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হল আর্য আধিপত্য এবং আর্যদের বর্ণ প্রথার মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন। সে সময়কার ভারতবর্ষীয় জনসাধারণের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন বলেন- (অনুবাদ) “পণ্ডিত ব্রাহ্মণগণ ক্ষমতার বলে অত্যাচারীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। গতানুগতিক কৌলিন্য প্রথার দরুন জাতিভেদের নিয়মকানুনগুলো কঠোর হতে কঠোরতর হয়েছিল। জাতিভেদ প্রথা ক্রমান্বয়ে মানুষে মানুষে ব্যবধান আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা নিম্নশ্রেণীর লোকদের জন্য শিক্ষায়তনের দ্বার চিররুদ্ধ করে রেখেছিল। শুধু তাই নয়, বাজারে বিক্রয়যোগ্য পণ্যের ন্যায় পৌরানিক ধর্মে ছিল ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকার”। (History of Bengali Language and Literature)।
এমনি অবস্থার প্রেক্ষাপটে আরম্ভ হয় ভারতর্ষীয়দের সঙ্গে ইসলাম ও মুসলিম শাসনের প্রথম পরিচয়। কালিকট, সুরাট ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় বাণিজ্য বন্দরে আরব পারশিক সওদাগরী পণ্যের সঙ্গে আসতে আরম্ভ করে ইসলামের সওগাত। খৃস্টীয় অষ্টম শতকের দ্বিতীয় দশকের প্রারম্ভে আরবীয় মুসলমানরা সিন্ধু- মুলতান দখল করে। তারও প্রায় তিনশ’ বছর পর উত্তর দিক থেকে মুসলিম অভিযানকারীরা এসে অধিকার করে পেশোয়ার ও লাহোর। সিন্ধু মুলতানে স্বল্পকালীন আরব আধিপত্য অবসানের পর একাদশ ও দ্বাদশ শতকে গযনীর সুলতান মাহমুদ ও শিহাব-উদ-দীন মুহম্মদ ঘুরীর ভারত আক্রমণ এবং অবশেষে মুহম্মদ ঘুরী কর্তৃক এই উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তি। আরম্ভ হয় ভারতবর্ষে দীর্ঘস্থায়ী মুসলিম শাসন প্রথমে তুর্কী ও তুর্কী আফগান এবং পরে মুঘল শাসন। প্রকৃত প্রস্তাবে সুদীর্ঘকালের এই শাসন বিপ্লবাত্মক ইসলামী শাসন ছিল না; যথার্থভাবে বলতে গেলে তা ছিল মুসলিম শাসন। বিপ্লবাত্মক ইসলামী শাসন বলতে আমরা বুঝাতে চাইছি ইসলামের নবীজি ( সাঃ ) প্রদর্শিত ও অনুসৃত শাসন ব্যবস্থা যা প্রয়োগ করেছিলেন খোলাফায়ে রাশেদা এবং পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজ। মুসলিম জগতের বাদবাকি প্রায় সকল শাসকই অনুসরণ করে গেছেন রাজতন্ত্রীয় মুসলিম শাসন। ভারতবর্ষেও তার অন্যথা হয়নি।
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের প্রসঙ্গে স্বনামধন্য চিন্তাবিদ মানববেন্দ্রনাথ রায় বলেনঃ “ভারতবর্ষে অনুপ্রবিষ্ট হওয়ার পূর্বেই তার গতিশীল ভূমিকার অভিনয়টুকু ইসলাম শেষ করে ফেলে। সিন্ধু ও গঙ্গার তীরে বিপ্লবী আরবেরা তার পতাকা রোপন করেনি, করেছে ইসলামে দীক্ষিত মধ্য এসিয়ার বর্বরেরা আর বিলাস বিহবলতায় নীতিচ্যূত পারস্যবাসীরা। মোহাম্মদের স্মৃতিতে রচিত বিরাটতম কীর্তিস্তম্ভ আরব সাম্রাজ্যকে এরাই করেছে বিপর্যন্ত। তবু ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়ায় বৌদ্ধ বিপ্লব যখন পর্যুদস্তু হয়ে গেলো আর তাতেই হলো ভারতের সমাজে বিশৃঙ্খলার উৎপত্তি, তখন জনসাধারণ তা থেকে স্বস্তি ও মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচার জন্য ইসলামের বার্তাকেই জানালো সাদর সম্ভাষণ। ভারতের পারস্যবাসী কি মোগল বিজেতাদের কেউই আরব বীরদের যুগান্ত প্রবাহিত মহানুভবতা, সহিষ্ণুতা কি উদারতা থেকে নিজেদের একেবারে দূরে সরিয়ে ফেলে নি। দূর দেশের পরস্থাপকারী আক্রমণকারীর অপেক্ষাকৃত ছোট একটি দল একশত বৎসর ধরে এই বিরাট দেশের শাসনকর্তা হয়ে রইলো আর লক্ষ লক্ষ লোক তাদের বিরুদ্ধে প্রকৃতির এই বিশ্বাসই গ্রহণ করলো, এতেই প্রমাণিত হয় যে, ভারতীয় সমাজের বাস্তব প্রয়োজন তারা অনেকাংশে মেটাতে পেরেছে। এমন কি, প্রতিক্রিয়ার ভারে যখন তার বিপ্লবজনিত আদি উত্তাপের অনেকটাই হ্রাস পেয়ে গেছে তখনও ইসলাম হিন্দু সমাজে তার অনেক বিপ্লবাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে। আক্রমণকারীদের শক্তির উৎকর্ষের দ্বারা ভারতবর্ষে মুসলিম শক্তি ততটা সংহতি লাভ করেনি যতটা করেছে ইসলাম ধর্মের প্রচারণায় আর ইসলামের আইন কানুনের প্রগতিশীল রূপধারার সহায়তায়”। (মানবেন্দ্রনাথ রায় রচিত The Historical Role of Islam এর অনুবাদ ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, মুহম্মদ আবদুল হাই, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৬৯, পৃঃ ১০৩-১০৪)।
আমরা যদি ইসলামের নবীজি (সাঃ) প্রদর্শিত ও ৬৩২ খৃস্টাব্দ থেকে ৬৬১ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত অনুসৃত খোলাফায়ে রাশেদা বা সত্যাশ্রয়ী খলিফা চতুষ্টয়ের শাসনকে ইসলামী শাসন এবং পরবর্তীতে বিচ্যুত ‘রাজতন্ত্রী খলিফাদের শাসনকে মুসলিম শাসন বলে অভিহিত করি, তা হলে শ্রী রায় এর উপরিউক্ত মন্তব্যের যোক্তিকতাকে স্বীকার করে নিতে হয়। বস্তুত, ইসলামী খেলাফত ছিল তখনকার রীতির প্রেক্ষিতে একটি নির্বাচিত ভিত্তিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে নির্বাচিত নেতৃত্ব এবং দেশ ও জাতিকে পরিচালনায় সে নেতৃত্বের কর্তৃত্বও তখনকার রীতির প্রেক্ষিতে ছিল গণতান্ত্রিক; যেমন গণতান্ত্রিক ছিল রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম দিককার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব। পক্ষান্তরে, বংশানুক্রমিভাবে বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব ইসলামী খেলাফতের শাসন ছিল না, ছিল বাদশাহী বা রাজতন্ত্রীয় শাসন।
কিভাবে কোন ঘটনাক্রম অতিক্রম করে ইসলামী খেলাফত মুসলিম রাজতন্ত্রে পর্যবসিত হল, ইতিহাসে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে। এই পরিবর্তনের পরেও কিন্তু রাজতন্ত্রীরা ‘ইসলাম অনুসারী’ হিসাবে মুসলিম শাসক বলেই অভিহিত ও স্বীকৃত হয়ে আসছেন। তাই মুসলিম রাজতন্ত্রীদের শাসনকে মুসলিম শাসন বলেই চিহ্নিত করা সমীচীন। ইসলামী শাসনের পতাকায়ও অঙ্কিত থাকত সেই ইসলামের পরিচয়। সিন্ধু গঙ্গার তীরে সেই পতাকা যখন প্রোথিত হয়, তখন আরব সাম্রাজ্যের রাজধানী দামেস্কের মসনদে উপবিষ্ট ছিলেন, ‘খলিফা’ উপাধিধারী উমাইয়া বংশের বাদশা প্রথম ওয়ালিদ। সুদক্ষ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী অথচ রক্তলোলুপ অত্যাচারী স্বৈরশাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তখন সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের শাসনকর্তা। এই হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশেই সিন্ধুতীরে প্রেরিত হয়েছিল এক মুসলিম বাহিনী যার নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ বিন কাশেম। শ্রী রায় ব্যবহৃত ‘বর্বর’ শব্দটা এসব রাজপুরুষ সম্পর্কে যথার্থ না হলেও তারা যে সেই বিপ্লবাত্মক ইসলামের পতাকাবাহী ছিলেন না, তাতে কোন সন্দেহ নেই এবং এ কথাও সত্য যে এসব রাজতন্ত্রীরাই ইসলামের গতিশীল বিপ্লবাত্মক ভূমিকাকে কালিমালিপ্ত করেছেন। তবুও শ্রী রায় এর মতে এই প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম শাসকদের শিক্ষাদর্শে সেই বিপ্লবাত্মক ইসলামের যতটুকু আলোকরশ্মি বিদ্যমান ছিল, তার উচ্ছ্বলেই আলোকিত হয়ে উঠল ভারতীয় সমাজের পতিত অবস্থার অন্ধকার। এই মন্তব্যে ইসলামের অন্তর্নিহিত বিপ্লবী শক্তির পাশাপাশি ভারতীয় সমাজের তখনকার দুর্দশার আভাসও স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। শ্রী রায় এর পরবর্তী কথায় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ইসলামের এই পথচ্যুতির দিনেও ভারতবর্ষে মুসলিম শক্তির সংহতি স্থাপনে মুসলিম শাসককূলের শক্তির উৎকর্ষ যতটা না কার্যকরী ছিল, তার চাইতে বেশি কার্যকরী ছিল এই উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারকদের একনিষ্ঠ কর্মধারা।
এখানেই আসে ইসলামী শাসনের অবসানের পর মুসলিম শাসনামলে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে দ্বিধাবিভক্তির কথা। খোলাফায়ে রাশেদার শাসনকালে খলিফার উপর যে নেতৃত্ব কর্তৃত্বের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল, তা ছিল সর্বাত্মকভাবে একক। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে আরম্ভ করে সমাজের সকল দিকের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করতে হত খলিফাকে। যেভাবে ইসলাম মানব জীবনের প্রতিটি বিভাগে পরিব্যাপ্ত, খলিফার নেতৃত্বেও তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি বিভাগকে বেষ্টন করে ছিল। খোলাফায়ে রাশেদার সকল খলিফাই এমনি নেতৃত্বের যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু রাজতন্ত্রের কালে রাজা বাদশারা ছিলেন না এমনি ব্যাপক ও সর্বাত্মক নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অধিকারী। আর এই পরিস্থিতিতেই উদ্ভব ঘটে দ্বিধাবিভক্ত নেতৃত্বের একদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অন্যদিকে ধর্মীয় নেতৃত্বের। রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকল রাজা বাদশাদের কর্তৃত্বে, আর ধর্মীয় নেতৃত্ব চলে গেল সমাজে গন্যমান্য আলেম উলামাদের হাতে। এই দুই নেতৃত্ব সম্পর্কে কিছু বলার আগে অন্য একটি প্রাসঙ্গিক ব্যাপারে কিছু কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। নবীজি হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর সাহাবী ছিলেন যাঁরা, যাঁরা তাঁর সঙ্গে থেকে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন, সুখ দুঃখের ভাগী হয়েছেন, তাঁদের ঈমানী আবেগ ও দৃঢ়তার সঙ্গে পরবর্তী বিভিন্ন সময়ের ইসলাম অনুসারীদের ঈমানী আবেগ ও দৃঢ়তার তুলনামূলক কিছু কথা। সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন এবং আরও পরবর্তী কালের আলেম-উলামা সবাই কি একই পরিমাণে নবীজি (সাঃ) প্রদর্শিত ইসলামের রূপ ও ব্যাখ্যা হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন? না, তা তো করার কথাও নয়। প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার তুলনায় পরোক্ষ জ্ঞান কিছুটা দুর্বলতর হওয়ারই কথা। স্মৃতি ও শ্রুতির প্রভাবে ভারতম্য থাকাই স্বাভাবিক। নবীজি মুহম্মদ (সাঃ)-এর সাহচর্য, তাঁর প্রদর্শিত পথে চলার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান নির্দেশনা ও অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যতের জন্য তাঁর উপদেশাবলী যারা প্রত্যক্ষভাবে লাভ করেছেন, ইসলাম সম্পর্কে করণীয় কর্তব্য নির্ধারণের যোগ্যতা সেই সাহাবাগণেরই তো বেশি থাকার কথা। যোগ্যতার মাপকাঠিতে পরবর্তী স্তরে অবস্থান গ্রহণের অধিকারী হচ্ছেন পরোক্ষ শিক্ষা লাভকারী তাবেঈনগণ, আরও নিম্নত্তর স্তরে আরও পরোক্ষ শিক্ষা লাভকারী তাবে তাবেঈনগণ। এমনিভাবে পরোক্ষতার দূরত্ব বাড়তে বাড়তে আসে আলেম উলামাদের অবস্থান গ্রহণের কথা। এই বাস্তবতার সঙ্গে এ-ও উল্লেখ্য যে, যোগ্যতার মাপকাঠির একই স্তরে অবস্থান গ্রহণকারীদের মধ্যেও ঈমানী আবেগ ও অভিজ্ঞতায়ও নিজ নিজ চারিত্রিক বৈশেষ্ট্যের জন্য ঘটতে পারে তারতম্য ।
এই বক্তব্যের আলোকে বিবেচনা করলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হবে, কেন খোলাফায়ে রাশেদার অবসানে বাদশাদের অনভিপ্রেত কর্তৃত্ব ইসলাম অনুসারীরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তাছাড়া, প্রকৃত প্রস্তাবে বাদশা হলেও তাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় আবৃত ছিল ‘খলিফা’ উপাধির আবরণে; আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাহকে তারা মেনে নিতে অস্বীকার করেন নি। তাদের শাসনে মুসলিম সমাজের বিষয়াদি শরিয়াত অনুযায়ীই পরিচালিত হত। এভাবেই বাদশারূপী ‘খলিফা’রা সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধিকারী বলে স্বীকৃত হয়ে গিয়েছিলেন।
আর ওদিকে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃত্বের দায়িত্ব এসে বর্তাল তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও আলেম উলামাদের উপর। যদিও তাঁদের নেতৃত্ব সুসংগঠিত ছিল না, তবুও মুসলিম সমাজ তাঁদের ধর্মীয় নেতৃত্ব মেনে নিল। এই দুই নেতৃত্বের মধ্যে সহযোগিতা ছিল খুবই সামান্য। ধর্মীয় নেতৃত্বকে তার দায়িত্ব পালনে রাজা-বাদশারা খুব কমই সাহায্য করেছেন। যতটুকু করেছেন, তা নিজেদের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই। রাজা বাদশারা দেশের পর দেশ জয় করেছেন, আর ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সেসব দেশের মানুষকে ইসলামের প্রভাব বলয়ে এনে তাদের মধ্যে সংহতির বন্ধন দৃঢ়তির করেছেন। এবং একাজে বিজিত রাজ্যকে নিজ অধিকারে রাখার লক্ষ্যে রাজা বাদশারা ধর্মীয় নেতৃত্বকে সহায়তা দান করেছেন।
কিন্তু কালক্রমে স্বভাবতই ধর্মীয় নেতৃত্বেও এল সঙ্কট, এল মতপার্থক্য। আর এই মতপার্থক্য কখনো ইসলামের বিধি বিধান সংক্রান্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ফলশ্রুতিতে, কখনো শাসককুলের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে তাদের সুকৌশল হস্তক্ষেপে। সৃষ্টি হল বিভিন্ন ফেরকা, ফেরকার মধ্যে উপ ফেরকা।
মুসলিম জাহানের এমনি অবস্থায় ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হল মুসলিম শাসন। মুসলিম সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী বাগদাদে তখন আব্বাসীয় বংশের ‘বাদশাহী’ চলছে। ভারতবর্ষে এই মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যারা তাদের পরিচয় দিতে হলে কিছু প্রসঙ্গ কথার অবতারণা করতে হবে। আগেই বলা হয়েছে, ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার কালে মুসলিম জাহানের কেন্দ্রীয় শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন বাগদাদভিত্তিক আব্বাসীয় খলিফাগণ। ততদিনে মুসলিম জাহান এক বিশাল আকার ধারণ করেছে।
কিন্তু এই বিশাল সাম্রাজ্যের শাসন কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন যারা, তাদের সীমাহীন অযোগ্যতার জন্য সে সাম্রাজ্য দ্রুত ধাবমান হয় ধ্বংসের পথে। ৭৫০ সালে আবুল আব্বাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় খেলাফত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ১২৫৮ সালে, হালাকু খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল বাহিনীর নির্মম আক্রমণের মাধ্যমে। এই প্ৰায় পাচশ’ বছরের আবাসীয় খেলাফতের প্রথম শতবর্ষই ছিল প্রকৃত পক্ষে এক গৌরবোজ্জ্বল কাল। তারপর থেকেই আব্বাসীয় খলিফাগণ প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব হারিয়ে আমীর উজীরদের হাতে ক্রীড়নকরূপে মসনদে সমাসীন থাকেন। ফলে মুসলিম সাম্রাজ্যের একক শক্তিও হয়ে পড়ে খুবই হীনবল। এই সময়কালের মধ্যে অর্থাৎ আব্বাসীয় সাম্রাজ্য যখন হীনবল, তখন সাম্রাজ্যের দূরবর্তী এলাকায় কতিপয় স্বাধীন রাজ্য, এমন কি স্বাধীন ‘খেলাফতের’ উদ্ভব ঘটে। স্পেনে আরম্ভ হয় প্রথমে উমাইয়া শাসন ও পরে উমাইয়া খেলাফত, মিশরে ফাতেমীয় খেলাফত। কতিপয় স্বাধীন ফাতেমীয় রাজ্যের মধ্যে আফগানিস্তানে পযনী রাজ্য ছিল অন্যতম। এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আলপ্তগীন ছিলেন একজন তুর্কী ক্রীতদাস। আলপ্তগীনের মৃত্যুর পর তার পুত্র আবু ইসহাক ইবরাহীম গযনীর মসনদে আরোহণ করেন (৯৬৩-৯৬৬ খৃঃ)। অপুত্রক অবস্থায় তার মৃত্যু হলে আলপ্তগীনের দুইজন ক্রীতদাস বিলকাতিগীন (৯৬৬- ৯৭৫ খৃঃ) এবং পিরিতিগীন (৯৭৫-৯৭৭ খৃঃ) একে একে গযনীতে রাজত্ব করেন। অতঃপর গযনীর মসনদে আরোহণ করেন আলপ্তগীনের অন্য এক ক্রীতদাস ও জামাতা সবুক্তগীন (৯৭৭-৯৯৭ খৃঃ)। তিনি কাসদার (মোটামুটিভাবে বেলুচিস্তান) রাজ্যটি দখল করে নেন এবং পাঞ্জাবের রাজা জয়পালকে যুদ্ধে পরাস্ত করে সে রাজ্যের লামগা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত বিরাট এলাকা নিজ রাজ্যভুক্ত করে নেন।
তার মৃত্যুর পর গযনীর মসনদে আরোহণ করেন তদীয় পুত্র আবুল কাশেম মাহমুদ (৯৯৮-১০৩০ খৃঃ) যিনি ইতিহাসে সুলতান মাহমুদ নামে পরিচিত। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৭ বার ভারত অভিযানকারী বিজয়ী বীর এই সুলতান মাহমুদের উৎসাহেই পারশ্যের মহাকবি ফেরদৌসী রচনা করেছিলেন বিশ্ব সাহিত্যের অবিস্মরণীয় মহাকাব্য ‘শাহনামা’। সুলতান মাহমুদের দরবারে অন্য রত্ন ছিলেন বিশ্বখ্যাত সুপণ্ডিত আল বিরুনী। সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর ১০৪০ সাল থেকে ১১৩৬ সাল পর্যন্ত আরও ১৪ জন কমজোর সুলতান গখনীর মসনদে সমাসীন ছিলেন। তাদের সময়েও ভারতবর্ষের অধিকৃত এলাকা গযনী রাজ্যেরই অন্তর্ভূক্ত ছিল। আফগানিস্তানের আর একটি ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্যের কথা বলা আবশ্যক। রাজ্যের নাম গুর বা ঘুর। গযনী সালতানাতের পতনের পর ঘুর রাজ্যের সামন্ত মালিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইতিপূর্বে ১১৬০ সালে তুর্কীরা গযনীর সুলতান খসরু শাহকে গযনী থেকে বিতাড়িত করে পাঞ্জাবে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। ঘুর রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় ১১৬৩ সালে, গিয়াসুদ্দীন মুহম্মদের মাধ্যমে। তিনি ১১৭৩ সালে গযনী থেকে তুর্কীদের বিতাড়িত করেন এবং গযনী ও কাবুলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা মুইযুদ্দীন মুহম্মদকে। ইতিহাসে তিনিই মুহম্মদ ঘুরী নামে পরিচিত। দীর্ঘকাল ভাইয়ের অধীনে শাসনকর্তা ও সেনাপতিরূপে নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে এক বিরাট মুসলিম সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন মুইযুদ্দীন মুহম্মদ ঘুরী। ১২০৩ সালে ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনিই হন ঘুর সাম্রাজ্যর সুলতান ।
এই সুলতান মুহম্মদ ঘুরীরই এক ক্রীতদাস কৃতবুদ্দিন আইবক ছিলেন ভাতবর্ষের মুসলিম অধিকৃত অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসনকর্তা। তিনি ছিলেন তুর্কী বংশোদ্ভূত এক যোগ্য শাসনকর্তা এবং ১২০৬ সালে মুহম্মদ ঘুরীর মৃত্যুর পর তার দ্বারাই ভারতবর্ষে আরম্ভ হয় স্বাধীন সুলতানী শাসন (১২০৬-১২১০ খৃঃ)। এই সুলতানী শাসনের ব্যাপ্তিকাল ১২০৬ সাল থেকে আরম্ভ করে ১৫২৬ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত, যার মধ্যে বিভিন্ন বংশীয়দের হাতে ন্যস্ত ছিল সাম্রাজ্যের শাসনভারঃ প্রথমে তুর্কী শাসন, তারপর খিলজী বংশীয়দের, তুগলক বংশীয়দের, বলবন বংশীয়দের এবং সৈয়দ ও লোদী বংশীয়দের শাসন। এই লোদীদের হাত থেকেই ১৫২৬ সালে সাম্রাজ্যের অধিকার চলে যায় মুঘল বংশীয় সম্রাট বাবরের হাতে।
অঞ্চল ভিত্তিক জাতিত্ব পরিচয়ে ভারতবর্ষের সুলতানেরা ছিলেন তুর্ক এবং তুর্ক আফগান ও আফগান। সম্রাট বাবরও ছিলেন আফগান। তদুপরি, বংশীয় বিশদ পরিচয়ে পিতৃকুলে বাবর ছিলেন সেই স্বনামখ্যাত তুর্কী বীর তৈমুরের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ এবং মাতৃকুলে তার পুর্বপুরুষ ছিলেন আর এক বিশ্বখ্যাত মোঙ্গল বীর চেঙ্গিস খান। মোঙ্গলদের সঙ্গে রক্তসম্পর্কিত বলেই বাবর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের নাম মুখ রাজবংশ।
এখানে উল্লেখ্য যে, ওইকালে মুসলিম রাজপুরুষ বা সেনাপতি সেনাধ্যক্ষদের আশ্রয়ে লালিত পালিত ‘ক্রীতদাস’ কিন্তু আমাদের প্রচলিত ধারণার ক্রীতদাস ছিল না। তখনকার দিনে যুদ্ধবন্দী অনেক তরুণ বা যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে আশ্রয়হারা অনেক
বইটি ডাউনলোড করে নিন নিচের দেয়া লিঙ্ক থেকে এবং পড়ে নিন সহজেই। লিঙ্কে ক্লিক করে ডাউনলোড করতে না পারলে আমাদের জানিয়ে দিন। ফিক্স করে দেয়া হবে। অথবা নিচে কমেন্ট করুন কেমন লাগলো বইটি!
বই পড়া অনেকের জন্য নেশা, অনেকের জন্য পরম ভালোবাসার একটি বস্তু। এই বইকে আমরা সহজলভ্য এবং সহজে পাওয়ার বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছি, তাই আমাদের সাইট আমরা ডিজাইন করেছি ইউজার ফ্রেন্ডলিনেস বজায় রেখে। সাইটের কোনো ধরনের ইস্যু নিয়ে কোনো মতামত থাকলে জানাতে পারেন, এবং বই এর জন্যে রিকুয়েস্ট করতে পারেন উপরে বাটন দেয়া আছে নিচেও লিঙ্ক দেয়া আছে। সর্বোপরি সকলের সহযোগিতা কাম্য সাইট চালাতে হলে, ইনশাআল্লাহ আমরা সকলেই বই পড়ে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবো!